পর্ব ঃ ২ ( শেষ)
আর কোনো প্রশ্ন নয় । মেয়েটাকে রুমের ভিতরে নেওয়া হয়েছে । ডাক্তার আমাকে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে বললেন ।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় গুনছি । আর ঠিক এ সময়ই আবার মাথায় এল কথাটা , কি বললাম আমি । আমার তো কোনো বোন নেই । আর বৃথা আমি কেন পরের ভাই হতে যাবো । না , না , এ তো অসম্ভব ।
হয়তো আবার কোন বিপদে পড়ি । মনে পড়ে যায় , একদিন এক যুবককে সাহায্য করেছিলাম । কিন্তু প্রতিদানে পরদিন তার কাছ থেকে কিছু লাঞ্চনা পেয়েছিলাম । যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । এও কি সেরকম কিছু হবে ? হতেও তো পারে , অবশ্যই হবে এটা তো বলছি না ।
কিছুক্ষন পরে একটা নার্সকে জিজ্ঞাসা করলাম , ভিতরের অবস্থা সম্পর্কে ।
কিন্তু জবাবে সে বলল ঃ ব্যস্ত হবেন না । আরো কিছু সময় অপেক্ষা করুন ।
কত সময় আর অপেক্ষা করব ? আমাকে যে মামার বাসায় যেতে হবে । হয়তো এতক্ষন মামার বাসার ফোনটা বেজে উঠেছে । মামা হয়তো বলেছে -- এখনো পৌছায় নি , পাজি ছেলে তো । এই সব ।
বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না । নার্স এসে খবর দিলো -- এবার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন ।
আসলে , গুরুতর তেমন কিছু হয় নি । মাইক্রোবাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথাটা হয়তো আবার রাস্তায় ধাক্কা খায় । আর সেই জন্যই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল । যাক ভাবনা তাহলে কিছুটা কমলো । ভয় ছিলো গুরুতর কিছু হয় কিনা । কিন্তু আল্লাহ তো আছেন , তার দয়ায়ই তো বেঁচে গেল মেয়েটা ।
আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম । দেখি , ভিতরে দু'টি মাত্র বেড । একটিতে শুয়ে আছে মেয়েটা ।বয়স আর কত হবে , চৌদ্দ বা পনেরো । চেহারাটা মায়াবী । মেরুন কালারের ড্রেসে পরীর মতো লাগছে মেয়েটিকে । অপর বেডটা ফাঁকা পড়ে আছে । এখনো সে ভালোভাবে সুস্থ হয়ে ওঠে নি । আমি কথা বলতে যাব , এমন সময় নার্স এসে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন হাতে । তাতে হিজিবিজি অক্ষরে কয়েকটা ঔষধের নাম লেখা আছে । বলল -- এগুলো এখনই প্রয়োজন । ফলে আর কথা হলো না । আমি দ্রুত বের হয়ে গেলাম ।
ফার্মেসী থেকে ফিরে এলাম । দেখি , এখনও সে শুয়ে আছে , ছাদের দিকে মুখ করে । ছাদে সে একটানা তাকিয়ে আছে । মাথার ব্যাথাটা হয়তো এখনো কমে নি । ডাক্তার মস্ত বড় একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে । আমি একেবারে পাশে না যেয়ে একটু দূর থেকে ডাকলাম ---- আলেয়া......।
উত্তর পেলাম না । হয়তো শুনতে পায় নি । নয়তো বুঝতে পারে নি , কাকে ডাকলাম আমি । এবার কাছে এসে মাথার কাছের তাকে ( ওষুধপত্র রাখার জন্য ছোট টেবিল মত ) ওষুধগুলো রেখে আবার ডাকলাম ।
এবার কিন্তু সাড়া মিলল । আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল --- জী , আমাকে ডাকছেন ?
আমি বললাম ---- হ্যা তোমাকে ।
সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারল না । বলল ---- আমাকে ! , কিন্তু আমার নাম তো আলেয়া না । আমার নাম ঝুমুর ।
ইশ ! কি বলতে কি বলে ফেলেছি । নিজের জিহ্বাতে নিজেই কামড় খেলাম । তা যাই হোক , নাম তো আমার জানাই ছিল না , এবার না হয় জানা হলো । নিজেকে কিছুটা হলেও সামলে নিলাম । তারপর বললাম ---- আসলে ঘটনা কি , আমি তোমার নামটা জানি না । তাছাড়া তোমাকে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে হয় না । তাই নামটা আমিই খাটিয়ে দিলাম , এই আর কি ?
--- আপনি দিয়েছেন মানে ?---- অবাক-অবাক সুরে আলেয়ার প্রশ্ন ।
--- হ্যা , সত্যি আমি দিয়েছি । কিন্তু কোনো উপায় ছিলো না ---- তারপর ঘটনা দু'মিনিটেই ফাস করে ফেললাম । পরিশেষে বললাম --- এমন অবস্থায় আমি কি করতাম , তুমিই বলো ?
ঘটনা শুনে আলেয়া বলল ---- ও তাহলে আপনিই আমাকে বাচিয়ে তুললেন ?
এমন সময় সেই রিক্সাওয়ালা , মানে আলেয়ার রিক্সাচালক এলো । দেখলাম , তার পায়েও ব্যান্ডেজ করা । কিছুটা খুড়িয়ে হাঁটছে সে । বলল ---- আপনি এখানে ? তা কেমন আছেন ?
আলেয়া একটু মৃদু হেসে সংক্ষেপে জবাব দিলো ---- ভালো আছি ।
এই প্রথম খেয়াল করলাম , মেয়েটি হাসলে তার মুখে টোল পড়ে । খুব সুন্দর লাগে তার মৃদু হাসিতে ।
এবার রিক্সাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল ---- খোদার কি রহমত, ঠিক সময়ে যদি না আসতেন তবে কি যে হতো আল্লাহ'ই ভালো জানেন ।
---- কি আর হতো , রাস্তায় পড়ে থাকত ।
---- কি যে বলেন ভাইসাব , আসলে আজকের ঘটনার জন্যি আমি দুখ্যিত । কারন কি জানেন ভাই ? এটা তো ঢাকা শহর , নিরাপদ না । ঢাকা মানে হইল গুন্ডা-মাস্তানের আস্তানা । মাস্তানেরা দিন-দুপুর বেলা যাকে ইচ্ছে মেরে থুয়ে যায় ।কোনো পাবলিকের হাত দেওয়ার সাহস নাই । যদি তার উপরও চাপ আসে এই ভয়ে । নয়তো , আমরা কি মানুষকে ভালোবাসতে পারি না ।
একজন রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনে মনটা খুব নরম হয়ে গেলো । সত্যি তো , মানুষ হয়েও মানুষ মানুষকে এতো ভয় পায় । বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে । যাই হোক , রিক্সাওয়ালাকে আমি বাইরে ডেকে নিয়ে গেলাম । তারপর , তার হাতে একশত টাকার একটা মুজিবর মার্কা নোট গুজে দিলাম । সে যেন কিছু সময়ের জন্য অবাক হলো । বলল --- টাকা ক্যান দেন ভাইসাব ?
আমি বললাম --- দেখুন , আপনার রিক্সায় মেয়েটা আহত হয়েছে । তাছাড়া , আপনি নিজেও তো অসুস্থ । সারাদিন তো আর কাজ করতে পারবেন না ।
সে এবার একটু দৃঢ়স্বরে বলল ---- দ্যাখেন ভাইসাব , রিক্সাচালক হয়েছি বলে এতোটা ছোটো লোক আমি না । আপনার টাকা আপনি রাখেন ।
বলেই দ্রুত খুড়িয়ে হেটে চলে গেল ।
আমি তার যাওয়া পথের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম । হয়তো মনে মনে ভাবলাম , গরিব মানে স্বার্থপর নয় । আসলে , তারাই প্রকৃত মানুষ । সোনাকে যেমন বার-বার জ্বালিয়ে অলংকার বানানো হয় , তেমনি গরিব মানুষগুলো সারাদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে খাটি মানুষে পরিনত হয় ।
আমি কেবিনে ফিরে আসলাম ।
আলেয়া আমাকে বলল ----- দেখুন , আমার তো কোনো ভাই নেই , তাই আজ থেকে আপনি আমার ভাই । আমার ভাগ্যটা অনেক ভালো । তাই তো তোমার মতো কাওকে ফ্রিতে পেয়ে যাবো ।
যাই হোক , একথায় তার মুখ থেকে একটি পুরনো জিনিস উঠে গেলো । যেটা আমি অনেক আগেই তুলে দিয়েছি ।
---- কি সত্যি ? আসলে আমারও তো কোনো বোন নেই । আছে একটা ভাই ।
---- ওয়াও !!! , তবে তো খুব মজা হলো । কোনো সমস্যাই থাকলো না ।
এবার আলেয়া একটু অন্য সুরে বলল --- দ্যাখো , আর একটি কথা তোমাকে বলি , সবার নিকট আমি ঝুমুর , কিন্তু ভাইয়া , তোমার কাছে না । তোমার কাছে তোমার আলেয়া , মনে রেখো । চলো , বেরিয়ে পড়ি ।
আমি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম ---- এখনি ? তোমার কি সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে ?
---- না , মাথায় এখনো ব্যাথা আছে । কিন্তু বাসায় তো যেতেই হবে । জানি না বাসার সিচুয়েশন এখন কেমন । মা-বাবার মনের অবস্থা যে কি , বুঝতে পারছি না , সেই সকাল থেকে আমি বাসায় নেই । এখন তো বিকাল হলো ।
সত্যি তো , এখন বিকাল প্রায় পাচটা বাজতে গেছে । দুপুরটা আমি অবশ্য হোটেলেই কাটিয়েছি । আলেয়ার জন্যেও কিছু জল-খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম । এখন আর থাকা উচিত হবে না । তাই বাসার জন্যে পা বাড়ালাম ।
আমি বললাম ---- চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি ।
আলেয়া কোনো দ্বিমত করল না ।
[ চলবে .................. ]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন